সাহিত্যকে বলা হয় মানব ও সমাজ জীবনের দর্পণ বা প্রতিচ্ছবি। সাহিত্যে মানব মনের সুখ-দুঃখ, আনন্দ-বেদনা এবং মানবজীবনের শাশ্বত ও চিরন্তন অনুভূতি প্রতিফলিত হয়। ইংরেজী Literature এর প্রতিশব্দ হিসেবে ‘সাহিত্য’ শব্দটি ব্যবহার করা হলেও বস্তুতঃ ‘Literature’ বলতে ব্যাপক অর্থে যাবতীয় লিখিত ও মুদ্রিত গ্রন্থ বা রচনা সমূকে বুঝানো হয়। যেকোন মুদ্রিত গ্রন্থ, রান্নার রেসিপি, পঞ্জিকা, আইনগ্রন্থ, গবেষণাগ্রন্থ, বৈজ্ঞানিক কল্পকাহীনি এমনকি চিকিৎসা বা খেলাধুলা শেখার বইও ‘Literature’ এর আওতাভূক্ত। তবে বাংলায় ‘সাহিত্য’ বলতে আমরা সাধারণত গল্প, উপন্যাস, গীতিকবিতা, মহাকাব্য, নাটক তথা সেই সমস্ত রচনাকে স্বীকৃতি দিয়ে থাকি, যেগুলো জীবন প্রবাহের বিচিত্র ও জটিল অভিজ্ঞতাসমূহকে মন্থন করে কোনো ‘বিশেষ সৃজন’ রূপে প্রকাশিত।

বর্তমানে কাগজে মুদ্রিত সাহিত্য ডিজিটাল প্লাটফর্মে তার আপন মহিমায় জায়গা করে নিলেও সাহিত্যের সেই জৌলুস এখন আর আগের মত নেই। এখন পাঠকের তুলনায় সাহিত্য রচনাকারীর সংখ্যা অনেক বেশী। অসংখ্য ব্লগ আর গল্প-কবিতার ওয়েবসাইট এর পাশাপাশি এখন গুগলে সার্চ করলেই মিলে যায় যেকোন প্রশ্নের জবাব। নিঃসন্দেহে এখনকার সাহিত্যভান্ডার আগেকার তুলনায় হাজার গুণ বেশী সমৃদ্ধ। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশতঃ সাহিত্যের নির্যাস গ্রহণ করা পাঠকের সংখ্যা এখন যারপরনাই সংকুচিত। এখনকার শিক্ষার্থীরা ছাপানো গল্প বা কবিতার বই কেনার কথা ভাবতেই পারেন না, তদুপরি ডিজিটাল প্লাটফর্মে ফ্রীতে সাহিত্য চর্চার সুযোগ থাকলেও এর পরিবর্তে তারা ফেসবুক বা টুইটারে রঙ্গরস করতে অধিকতর পারদর্শী। ইউটিউবে একটা শিক্ষামূলক ভিডিও প্রকাশ করলে যতগুলো ভিউ হয় তার থেকেও অনেক বেশী ভিউ হয় একটা ফানি ভিডিও কিংবা নোংরামো ভিডিও প্রকাশ করলে। ইন্টারনেটে গল্প-কবিতা বা কোন ব্লগ সাইটে ঢুকে ব্লগগুলো পড়ার থেকে চোখে দেখা বিশেষ করে ইউটিউবে প্রকাশিত অর্থহীন ভিডিওগুলো অধিকতর প্রাধান্য পায় একজন শিক্ষক কিংবা শিক্ষার্থীর নিকট।

সব থেকে বড় আশ্চার্যের বিষয় হচ্ছে পাঠ্য পুস্তকের পড়াটাও এখন হয়েছে কমার্শিয়াল। আমাদের সময়ে আমরা এক ক্লাশের পরীক্ষা শেষ হতে না হতেই পরের ক্লাশের শিক্ষার্থীর নিকট থেকে পুরাতন বই সংগ্রহ করার জন্য ব্যস্ত হয়ে যেতাম। ফলাফল প্রকাশের খবর নেই, বই সংগ্রহ করেই সাহিত্য থেকে মজার মজার গল্পগুলো পড়ে শেষ করা এবং সুন্দর সুন্দর কবিতা আবিৃতির নিমিত্তে মুখস্ত করতাম। এখনকার দিনে এটা কল্পনাও করা অসম্ভব। যদিও সরকারীভাবে শিক্ষা বছরের শুরুতেই শিক্ষার্থীদের হাতে হাতে বই তুলে দেয়া হয় তবুও্ নতুন বইয়ের গন্ধ আকৃষ্ট করে খুব কম সংখ্যক শিক্ষার্থীকেই। পরীক্ষার খাতায় কবিতা লিখতে হবে না তাই কবিতা মুখস্থ করার কোন প্রশ্নই আসে না। আর সব বড় বড় প্রবন্ধ বা গল্প পড়ে কী হবে? পরীক্ষায় তো থাকবে ‍সৃজনশীল আর কতিপয় বহুনির্বাচনী প্রশ্ন সুতরাং ওসব গল্প-প্রবন্ধ পড়ার থেকে সেদিকে মনযোগ দিলেই বরং পরীক্ষার ফলাফলটা ভালো হবে।

হয়তো সেই দিন আর বেশী দূরে নাই যেদিন একজন লেখক নিজে সাহিত্য রচনা করে নিজেই বার বার পড়ে আত্মশুদ্ধির পথ খুঁজবেন। কেননা, সাহিত্য চর্চা এখন বিলুপ্তির দোড়গোড়ায় গড়াগড়ি দিচ্ছে, কে জানে আদৌ কোনদিন এটা আবারও স্বমহিমায় পাঠকের হৃদয়ে জায়গা করে নিতে পারবে কি না।

By admin

3 thoughts on “সাহিত্য চর্চা এখন বিলুপ্তির দোড়গোড়ায় গড়াগড়ি দিচ্ছে”
  1. দারুন শিক্ষণীয় একটা লেখা। শুভ কামনা রইলো

  2. ভালো লাগলো।আসলেই এখন মানুষ সাহিত্যের জন্য এতো ব্যাকুল না।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *