কোন মানুষ তার চারপাশের পরিবেশকে যেভাবে দেখতে চান ঠিক সেভাবে দেখতে পেলে তখন নিজেকে তিনি সুখী মনে করেন। আর ব্যতিক্রম হলেই তার কাছে সেটা একটা দুঃখ বলে বিবেচিত হয়। একজনের অর্থনৈতিক স্বচ্ছলতা নেই এটা তার দুঃখ; আর অন্যজনের এত অর্থ সম্পদ যা দেখে অন্যরা হিংসে করে এটা তার দুঃখ। কেউবা সন্তানাদি হয়নি বলে দুঃখ করে আর কেউবা সন্তানকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারছেন না বলে দুঃখ করে। সন্তান মানুষ করার পর শেষ বয়সে বৃদ্ধাশ্রমে থাকতে হচ্ছে এটা নিশ্চয় তার জন্য সুখের বিষয় নয়। আর বাবা-মার নিকট থেকে সহায় সম্পদ লিখে নিয়ে সন্তানেরা বাবা-মাকে বাড়ি থেকে বেড় করে দেয়, আজকাল নাকি এটাও ঘটে। এরপরেও যদি কোন বাবা-মা দুঃখ প্রকাশ না করেন তাহলে ঐ বাবা-মার থেকে সুখী দুনিয়াতে আর কে থাকতে পারে?
সুখী মানুষের গল্পটা সম্ভবত অনেকেরই জানা। রাজামশাই হাড় মরমর রোগে আক্রান্ত হলে বহু চিকিৎসক, বৈদ্য, হেকিম, ওঝা দেখানো হলো, কিন্তু কেউ রোগ সারাতে পারছিলেন না। অবশেষে এক চিকিৎসক রাজামশাইকে ভালোভাবে দেখে বললেন, “সুস্থ হতে হলে রাজামশাইকে সুখী মানুষের ‘জামা’ পরাতে হবে”। ব্যাস, শুরু হলো সুখী মানুষের সন্ধান, কিন্তু গোটা রাজ্য তন্ন তন্ন করে খুঁজেও রাজ্যের কোথাও কোন সুখী মানুষ খুঁজে পাওয়া গেল না। অবশেষে অনেক হয়রানীর পর একজন সুখী মানুষ পাওয়া গেল ঠিকই কিন্তু দূর্ভাগ্য বশতঃ তার কাছে কোন ‘জামা’ পাওয়া গেলনা, কারণ তার কোনপ্রকার জামা’ই ছিল না।
সুখী হওয়ার সাথে অর্থ সম্পদ এর একটা সম্পর্ক থাকলেও এটা কোন মূখ্য বিষয় নয়। যখনই কোন মানুষ বাহ্যিক উপকরণ গুলোকে তার নিজের সুখ কিংবা দুঃখের কারণ বলে বিবেচনা করে তখনি তার মাঝে সুখ কিংবা দুঃখের অনুভূতিটা প্রবল হয়। বস্তুতঃ সুখ এবং দুঃখ হচ্ছে মানব জীবনের দু’টো ভিন্ন অনুভূতি যা মানুষ স্বেচ্ছায় নিজের অন্তরে জাগ্রত করে নিজেক সুখী ভাবে কিংবা কষ্ট পায়। কোন মানুষ যখন নিজের প্রাপ্তিগুলোকে উপেক্ষা করে অপ্রাপ্তিগুলোকে নিয়ে টানা হ্যাঁচড়া করে, তখনই তার অন্তরে দুঃখবোধটা জাগ্রত হয়।
জীবনের আর এক নাম গতি। বিজ্ঞানের পরিভাষায়, “পারিপার্শ্বিক নির্দেশতন্ত্রের সাপেক্ষে সময় পরিবর্তন এর সঙ্গে সঙ্গে কোন বস্তু স্থান পরিবর্তন করলে, ঐ বস্তুর অবস্থাকে গতি বলে”। নির্দিষ্ট প্রসঙ্গ কাঠামোর সাপেক্ষে যদি কোন বস্তুর অবস্থানের পরিবর্তন না ঘটে তবে বস্তুটি তার পারিপার্শিকের বা প্রসঙ্গ কাঠামোর সাপেক্ষে স্থির, গতিহীন, অচল, স্থবির তথা ধ্রুব বা সময়-অপরিবর্তিত অবস্থানে রয়েছে বলা হয়। পদার্থ বিজ্ঞানের ভাষায় এই অবস্থাকে স্থিতি বলা হয়। অপরদিকে প্রসঙ্গ কাঠামোর বা পারিপার্শ্বের সাপেক্ষে যখন কোন বস্তুর অবস্থানের পরিবর্তন ঘটে তখন একে বলে গতিশীল বস্তু এবং এই ঘটনাকে গতি বা Motion বলা হয়। অর্থাৎ পৃথিবীর যেকোন বস্তু দুটি অবস্থার যেকোন একটি অবস্থায় বিরাজ করে, হয় গতিশীল নয়তো স্থিতিশীল। একই সঙ্গে কোন বস্তুর মাঝে গতিশীলতা এবং স্থিতিশীলতা থাকতে পারে না, আর এটাই স্বাভাবিক। কোন মানুষ এই স্বাভাবিক বিষয়টাকে স্বাভাবিক ভাবে গ্রহণ করতে পারলে সেই হচ্ছে সুখী মানুষ।
জীবন মানেই গতিশীল কিছু, আর গতি মানেই সেখানে উত্থান-পতন থাকবে। বস্তুতঃ মানুষের সুখ-দুঃখের মূলেই রয়েছে গতির উত্থান-পতন কিন্তু খুব কম মানুষই এটা উপলব্ধি করে যে গতির উত্থান-পতন তার নিজের নিয়ন্ত্রণাধীন নয়। গতি নিয়ন্ত্রিত হয় এক মহা জাগতিক শক্তি দ্বারা। তথাপিও যারা গতির উত্থানকে নিজের কারিশমা বলে নিজের অন্তরে জাগ্রত করে শান্তি লাভ করেন; তারাই গতির পতন ঘটলে নিজেকে দুঃখীদের অন্তর্ভূক্ত করেন। কোন মানুষের পক্ষে তখনই সুখী হওয়া সম্ভব যখন তিনি জীবনটা একটা গতির সাথে তুলনা করতে সক্ষম হবেন। সুতরাং কোন মানুষের জীবনে যখন যাই ঘটুক না কেন সেটাই তো গতির ধর্ম। গতির ধর্মকে স্বীকার করে নিলে সুখ-দুঃখ নিয়ে আর মাথা ঘামানোর প্রয়োজন পড়ে না। আর যিনি সুখ-দুঃখ নিয়ে মাথা ঘামান না তার থেকে সুখী আর কে হতে পারে?