সন্তান বড় হয়ে একজন ডাক্তার বা ইঞ্জিনিয়ার হবে বেশিরভাগ পিতা-মাতাই এমন স্বপ্ন দেখেন। যদি কোন পিতা-মাতা বলেন, তার সন্তান বড় হয়ে একজন ন্যায় বিচারক কিংবা সমাজ সেবক কিংবা সাহিত্যিক কিংবা গবেষক কিংবা বিজ্ঞানী কিংবা প্রযুক্তিবিদ হবে, তাহলে সেটা সমাজের মানুষের কাছে হাসি-তামাশার বিষয় ছাড়া অন্যকিছু বলে বিবেচিত হবে বলে আমার মনে হয়না। কেননা, প্রাথমিক বিবেচনায় এসকল পেশা অর্থনৈতিক নিশ্চয়তা প্রদান করে না। ফলে এখন ভালো ছাত্র হওয়ার থেকে ভালো ফলাফলের গুরুত্বটাই সব থেকে বেশি। বস্তুতঃ সন্তানের বাহ্যিক আচার-আচরণ ও অন্যান্য প্রবণতার উপরই নির্ভর করে উক্ত সন্তান বড় হয়ে কী হবে না হবে। কিন্তু বেশিরভাগ পিতা-মাতাই এটা পর্যবেক্ষণ করেন না বা করার প্রয়োজনও মনে করেন না অথবা তারা বিশ্বাস করেন, তারা যা চাইবেন সেটাই হবে কিংবা হওয়া উচিৎ। বাস্তবতা হচ্ছে আমাদের চারপাশে এমন অনেক এ+ পাওয়া শিক্ষার্থী আছে যারা “আমি ……… সালে সকল বিষয়ে এ+ সহ জিপিএ ৫ পেয়ে এসএসসি/এইচএসসি পাশ করেছি” বাক্যটির ইংরেজী অনুবাদ করতে সক্ষম নন, সেটা সোশ্যাল মিডিয়ার কল্যাণে আজকাল অনেকেই জেনে গেছেন।
একজন শিক্ষার্থী গণিত বোঝে অথচ “Some People Have Curly Brown Hair Turned Permanently Black.” কিংবা “Some People Have Curly Brown Hair Through Proper Brushing.” এ জাতীয় বাক্য তার হৃদয়ে কোন প্রভাব বিস্তার করে না এটা অবিশ্বাস্য। আর যদি বিশ্বাসযোগ্য হয় তাহলে উক্ত শিক্ষার্থী যদি কেবল এ+ নয় বরং এ++ও পায় তবুও সে মেধাবী শিক্ষার্থী হতে পারে না। কেননা, গণিতের মূল মন্ত্রই হচ্ছে কতকগুলো ফর্মুলা, কাজেই গণিত শেখার অর্থই হচ্ছে কতকগুলো ফর্মুলার মাঝে নিজেকে হারিয়ে ফেলা; যা খুব কম সংখ্যক শিক্ষার্থীর মাঝেই পরিলক্ষিত হয়।
একইভাবে বিজ্ঞান বোঝে অথচ “হেলিনা কে রুবি সাজাবে ফ্রান্সে অথবা হেলিনা কে রুবি ছেঁচে ফেলেছে (H, Li, Na, K, Rb, Cs, Fr)” কিংবা “বিধবা মায়ের ক্যাডার সন্তান বাদশা রহিম অথবা বিরিয়ানী মোগলাই কাবাব সরিয়ে বাটিতে রাখ (Be, Mg, Ca, Sr, Ba, Ra)” বাক্যগুলোকে কেবল হাসির খোরাক হিসেবেই বিবেচনা করে, সে আর যাইহোক ভালো শিক্ষার্থী হতেই পারেনা। “বাবার হলো আবার জ্বর সারিলো ঔষধে(বাবর> হুমায়ুন> আকবর> জাহাঙ্গীর> সাজাহান> ঔরঙ্গজেব)” এরকম বাক্যগুলো একজন ইতিহাস পড়ুয়া শিক্ষার্থীর মাঝে ঝর তুলতে বাধ্য। তা না হলে তার ইতিহাস পড়াটাই বৃথা।
পরীক্ষায় এ+ পাওয়ার থেকে অধিকতর জরুরী একজন শিক্ষার্থীর মাঝে অভিযোজন ক্ষমতা বৃদ্ধি করা। তা না হলে সন্তান হয়তো লেখাপড়া শিখে ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার কিংবা আরও বড় কিছূ হবে, প্রকৃত মানুষ হবে কি না সে ব্যাপারে যথেষ্ট সন্দেহ থেকে যায়। কেবলমাত্র একটি পরিবারের অর্থনৈতিক চাহিদা পূরণ করার জন্য ডাক্তার কিংবা ইঞ্জিনিয়ার হওয়াটা জরুরী নয়। কেননা, একজন মানুষ জীবনে যত টাকাই উপার্জন করুন না কেন, শেষ বিদায়ে তাকে অন্য সকলের মত খালি হাতেই যেতে হয়। পবিত্র কুরআনের বাণী, “পার্থিব জীবন ক্রীড়া ও কৌতুক ব্যতীত কিছুই নয়। পরকালের আবাস পরহেযগারদের জন্যে শ্রেষ্টতর (আল আনাম/৩২)” অথচ আমরা সেখানে দুনিয়ার ভোগ-বিলাস ছাড়া আর কিছুই ভাবতে চাইছি না। আর দুনিয়ার ভোগ-বিলাসের কথা চিন্তা করি বলেই সন্তানকে স্বাধীনভাবে চিন্তা করার সুযোগ না দিয়ে যেন হাত পা বেধে ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার কিংবা আরও বড় কিছু হওয়ার যুদ্ধ ক্ষেত্রে নামিয়ে দিচ্ছি। এখন একজন ডাক্তার মানেই হচ্ছে টাকা উপার্জনের মেশিন আর একটা মেশিন কিভাবে মানুষের সেবা করবে? তাদের তো খোলা হাওয়ায় নিঃশ্বাস নেয়ারও সময় নেই।
প্রত্যেক পিতা-মাতারই উচিৎ সন্তানকে স্বাধীনভাবে মানুষ হতে সহায়তা করা, তাদেরকে কোন কিছু চাপিয়ে দেয়া নয়, আর তাহলেই একটি শিশু সত্যিকারের মানুষ হয়ে মানুষের সেবায় নিজেকে নিয়োজিত করতে সক্ষম হবে। কিলিয়ে কাঁঠাল পাকালেও প্রকৃতপক্ষে তা যেমন পাকে না, এ+ এর পিছনে ছুটলে উক্ত শিক্ষার্থী পরীক্ষায় এ+ পেলেও তার মাঝে প্রকৃতপক্ষে এ+ এর জ্ঞান অর্জিত হয় না।