“সসীম এর ভিতরে অসীম ঢুকেছে, অসীম হয়েছে সসীম”। অন্ততঃ আমার কাছে ঠিক এমনটাই মনে হচ্ছে। মানুষ যা কিছু তার নিজের জন্য প্রয়োজনীয় বলে মনে করে বস্তুতঃ সেটাই হচ্ছে রিযিক; অর্থনীতির ভাষায় বলে চাহিদা। যদিও অর্থনীতির ভাষায় মানুষের চাহিদা অসীম কিন্তু চাহিদা পূরণের উপকরণগুলো অসীম নয়। যেখানে মানুষের জীবনকালটাই সসীম, সেখানে তার চাহিদা অসীম হয় কীভাবে সেটাই আমার কাছে বোধগম্য নয়। মৌলিক চাহিদাগুলোর মধ্যে রয়েছে অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান, নিরাপত্তা ও স্বাস্থ্য। এই মৌলিক চাহিদাগুলো সকল মানুষের ক্ষেত্রেই সমভাবে প্রযোজ্য। কাজেই এগুলো ব্যতিত মানুষের আর যেসব চাহিদা রয়েছে সেগুলোকে চাহিদা না বলে বরং চাহিদার উপসর্গ বা উপ-চাহিদা বলাই যুক্তিযুক্ত বলে আমার কাছে প্রতীয়মান হয়।
‘রিযিক’ মহান আল্লাহ কর্তৃক নির্ধারিত এমন এক নেয়ামত যা মানুষ চাইলেই নিজের খেয়াল-খুশি মত অর্জন করতে পারে না। ‘রিযিক’ এর সর্বোচ্চ স্তর হচ্ছে স্বাস্থ্য/সুস্থ্য শরীর। তবে অসুস্থ মানুষ ছাড়া এই চরম সত্যটা অনেকেই উপলব্ধি করেন না। একজন মানুষের দিনে/মাসে/বছরে কতটুকু খাদ্যের প্রয়োজন? সাগরের একটি নীল তিমি এক গ্রাসে যে পরিমাণ খাদ্য গ্রহণ করে, উক্ত পরিমাণ খাবারে ২২৮ জন মানুষের ০১ দিনের খাদ্যের যোগান হয়ে যাবে। তার পরেও মানুষ যেভাবে খাদ্যের পিছনে ছুটে বেড়ায়, দুনিয়ার বুকে সৃষ্ট আর কোন প্রাণি সেভাবে খাদ্যের জন্য ছুটে না, এমনকি সাগরের নীল তিমিও না। বনের হিংস্র প্রাণি বাঘ/সিংহও উদরপূর্তি থাকা অবস্থায় শিকার ধরার প্রয়োজন মনে করে না, কিন্তু মানুষ করে। যে মানুষ জানে না, ঘুমানোর পর আদৌ সে আর ঘুম থেকে জাগবে কি না, সেই মানুষের চাহিদা হয়ে গেছে অসীম। চরম সত্যতা হচ্ছে “ঘুম ভাঙলে সকাল, আর যদি ঘুম না ভাঙে তাহলে নিশ্চিত পরোকাল; তাহলে কেন ‘রিযিক’ নিয়ে এত হাহুতাশ? আজকাল প্রায়ঃশই পিতা-মাতাগণ তাদের সন্তানদের বলে থাকেন, “লেখাপড়া না করলে কী করে খাবি?” সত্যিই এক আজব ব্যাপার! মানুষ ভিন্ন এই পৃথিবীতে দ্বিতীয় কোন প্রাণি খুঁজে পাওয়া যাবেনা যাদের খাদ্যের যোগান দেয়ার জন্য শিক্ষিত হতে হয়। যদিও সমগ্র পৃথিবী জুড়ে এখনো অগণিত মানুষ আছেন যারা শিক্ষিত না হয়েও নিজেদের খাদ্যের যোগান দিচ্ছেন। সম্ভবত তথাকথিত শিক্ষিতরা এদেরকে মানুষ বলেই মনে করে না। তা না হলে সন্তান ভবিষ্যতে কী করে খাবে এই চিন্তা করে সন্তানকে শিক্ষিত করার কথা ভাবতো না।
জ্ঞানের কোন সীমারখো হয় না। একজন মানুষ তার সমগ্র জীবনব্যাপী যত জ্ঞানই অর্জন করুন না কেন, তিনি যা জানেন তার বাইরে আর কিছু জানার নেই, একথা যিনি বলেন তিনি হয় পাগল নয়তো অজ্ঞ। অর্থাৎ জ্ঞান অসীম যা অর্জন করার জন্য স্বয়ং সৃষ্টিকর্তাই মানুষকে জোড় তাগিদ দিয়েছেন। অপরদিকে মহান সৃষ্টিকর্তা এটাও বলেছেন, “রিযিক এর ফায়সালা হয় আসমানে, জমীনে নয়। আর পৃথিবীর বুকে এমন কোন প্রাণি নেই যার ‘রিযিক’ এর দায়িত্ব তিনি নেননি।” সুতরাং এটা সুস্পষ্ট যে, মানুষের ‘রিযিক’ মহান সৃষ্টিকর্তা কর্তৃক নির্ধারিত। একদিকে ‘রিযিক’ হচ্ছে সসীম, অন্যদিকে এটা নির্ধারিত হয় মহান সৃষ্টিকর্তা কর্তৃক। সুতরাং ‘রিযিক’ তথা অন্ন সংস্থানের জন্য জ্ঞানার্জন তথা ‘শিক্ষা’ এটি নিশ্চিত একটি ভ্রান্ত ধারণা। বেঁচে থাকার জন্য অন্নের প্রয়োজন হলেও অন্নের জন্য শিক্ষার প্রয়োজন নেই, বরং শিক্ষা কেবলমাত্র জ্ঞান অর্জনের জন্যই প্রয়োজন।
শিক্ষালাভ করা তথা জ্ঞান অর্জন করা একটি অসীম বিষয়, আর অন্ন সংস্থান একটি সংকীর্ণ ব্যাপার মাত্র। অথচ আমরা অসীম বিষয়টিকে ঢুকিয়ে দিয়েছি সংকীর্ণ তথা সসীম বিষয়ের ভিতরে। আমরা কথায় কথায় ভাসন দেই, চোর-বাটপার, ঘুষ-দূর্নীতিতে দেশটা ছেয়ে গেছে। কিন্তু বাস্তবতা হলো, একজন শিক্ষিত মানুষ/চোর কলমের এক খোঁচায় যা চুরি করে বা করতে সক্ষম একজন অশিক্ষিত মানুষ/চোর জীবনভর চুরি করলেও তার সমকক্ষ হবে না। আর ঘুষ-দূর্নীতির সূতিকাগার হচ্ছে শিক্ষিত সমাজ। সুতরাং অশিক্ষা ঘুষ-দূর্নীতির জন্য দায়ী নয়।
শিক্ষা যদি রিযিক এর জন্য না হয়ে জ্ঞান অর্জনের জন্য হতো তাহলে চোর-বাটপার, ঘুষ আর দূর্নীতিতে দেশটা ছেয়ে যেত না। জ্ঞানকে সর্বদাই ‘আলো’ এর সাথে তুলনা করা হয়ে থাকে। আর ‘আলো’ এর কাজই হচ্ছে আঁধার দূরীভূত করা, আঁধার সৃষ্টি করা নয়। বস্তুতঃ আলোর চারপাশে কখনোই আঁধার থাকতে পারেনা। আঁধার সব সময়ই আলোর নীচে অবস্থান করে। জ্ঞান অর্জনকে অন্ন সংস্থানের মাধ্যম হিসেবে বিবেচনা করায় জ্ঞান এখন আর আলো ছড়ায় না। ফলে জ্ঞানের উপর-নীচ, চারপাশ সব দিকেই এখন আঁধার। আর এ কারণেই মানুষের চাহিদা হচ্ছে অসীম। কেননা, আলোর অভাবে সে দেখতেই পাচ্ছে না, কী কারণে তার এত সম্পদের প্রয়োজন; কী হবে তার এত সম্পদ দিয়ে; যেখানে চোখ বন্ধ করলেই সব অর্থহীন।
বাংলাদেশেও এমন অনেক শিল্পপতি আছেন যারা শিক্ষিত না হয়েও কোটি কোটি টাকার মালিক হয়েছেন। যাদের অধীনে কাজ করছে লক্ষ লক্ষ শিক্ষিত-অশিক্ষত শ্রমিক-কর্মচারী। তারপরেও শিক্ষা কীভাবে ‘রিযিক’ এর ভিতরে ঢুকে পড়লো তা নিয়ে যথেষ্ট গবেষণার প্রয়োজন আছে বলে আমার মনে হয়।