কবি কাজী নজরুল ইসলাম এর একটি বিখ্যাত উক্তি হচ্ছে, “বিশ্ব যখন এগিয়ে চলেছে, আমরা তখনও বসে- বিবি তালাকের ফতোয়া খুঁজেছি, ফিকাহ ও হাদিস চষে”। আমাদের দেশের বর্তমান সময়ের শিক্ষার হালচাল দেখে মনে হচ্ছে, নজরুল যদি আজ বেঁচে থাকতেন তাহলে হয়তো তিনি তার বিখ্যাত উক্তিটি পরিমার্জন করে বলতেন, “বিশ্ব যখন প্রযুক্তির জোয়ারে করছে টালমাটাল, আমরা তখনও প্রাইভেট কোচিং আর পরীক্ষা নিয়ে রয়েছি বেসামাল”।

ব্যক্তির দেহ, মন ও আত্মার সুষম বিকাশের প্রয়াস অর্থাৎ মানুষ যে বিকাশমান আত্মসত্তার অধিকারী তাকে সম্পূর্ণভাবে বিকাশ করার যে প্রচেষ্টা তাই হলো শিক্ষা। আর এই শিক্ষা লাভ এর নানা উপায় থাকলেও সর্বাগ্রে স্থান দেয়া হয় একাডেমিক শিক্ষাকে। একাডেমিক শিক্ষা হচ্ছে একটি সাধারণ মানের শিক্ষা যেখানে প্রত্যেক সেশন শেষে পরীক্ষা গ্রহণের মাধ্যমে যাচাই করা হয় সংশ্লিষ্ট শিক্ষার্থীদের মাঝে উক্ত লেবেলের শিক্ষা কতটুকু অর্জিত হয়েছে। অর্থাৎ পরীক্ষায় উত্তীর্ণদের প্রাথমিক ভাবে শিক্ষিত বলে স্বীকৃতি দেয়া হয়। কিন্তু একজন মানুষ একাডেমিক শিক্ষা নিয়ে যত বড় ডিগ্রীই অর্জন করুন না কেন, যদি তার মাঝে মনুষ্যত্বের শিক্ষা অর্জিত নাহয় প্রকৃতপক্ষে তাকে শিক্ষিতই বলা যায় না। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এর ভাষায়, “মনুষ্যত্বের শিক্ষাটাই চরম শিক্ষা আর সমস্তই তার অধীন”। শিক্ষার একটি অন্যতম প্রধান বৈশিষ্ট্য হচ্ছে, এটা মানুষকে ভালোটা গ্রহণ এবং মন্দটা বর্জন করতে উদ্বুদ্ধ করে। অথচ আমাদের দেশের তথাকথিত শিক্ষিতদের মাঝে এই বৈশিষ্ট্য খুব কমই পরিলক্ষিত হয়। বহুদিন আগে একবার এক ছাত্রকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম, আচ্ছা ভাই, আপনারা যে শান্তি চুক্তির বিরোধীতা করছেন, তাহলে কি আপনারা শান্তি চান না? উত্তরে ছাত্রটি বলেছিল, শান্তি চাই, তবে বিরোধী মানেই বিরোধীতা করা তাই বিরোধীতা করছি। কি অবাক কান্ড! একজন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীর জবাব যদি এরকম হয় তারপরেও কি বলা যাবে একাডেমিক শিক্ষাই একজন মানুষকে প্রকৃত শিক্ষিত করে?

ছোট বেলায় আমরা মজা করে বলতাম, “ছাত্রজীবন মধুর জীবন, যদি না থাকতো এক্সিমিনেশন”। কথাটা মজা করে বলা হলেও সত্য এটাই যে, শিক্ষার মাধ্যমে যদি ছাত্রদের জীবন মধুময় না হয় তাহলে উক্ত শিক্ষা থেকে শিক্ষার্থীরা কিছুই শিখবে না। এরিস্টটল বলেছিলেন, “শিক্ষার শেকড়ের স্বাদ তেঁতো হলেও এর ফল মিষ্টি”। সুতরাং শিক্ষা ব্যবস্থা এমনটাই হওয়া উচিৎ যে, এর শেকর (শিক্ষাদান পদ্ধতি) তেঁতো হলেও এর ফল (শিক্ষা পরবর্তী জীবন) মিষ্টি হতে হবে। কিন্তু আমাদের দেশের হাজার হাজার ছেলে-মেয়ে মাস্টার্স পাশ করে বেকার দিন যাপন করছে, আর কেউবা হতাশাগ্রস্থ হয়ে পড়েছে। এদের শিক্ষার ফল মিষ্টি এটা বোধ হয় কোন নির্বোধও মেনে নেবেন না। প্রকৃতপক্ষে এটা হচ্ছে পরীক্ষা নির্ভর শিক্ষা পদ্ধতির কুফল। শিক্ষা জীবনে অবশ্যই পরীক্ষার ব্যবস্থা থাকবে; তবে সে পরীক্ষা হওয়া উচিৎ এমন যেন শিক্ষার্থীরা কেবলমাত্র পরীক্ষা নিয়েই ব্যস্ত না থাকে।

শিক্ষার চূড়ান্ত ফল হচ্ছে সহনশীলতা। কোন মানুষ যতই অধ্যয়ন করবে সে ততই তার অজ্ঞতাকে আবিষ্কার করতে সক্ষম হবে। কিন্তু আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থা পরীক্ষা নির্ভর হওয়ায় এখন শিক্ষার্থীরা অধ্যয়নের মাধ্যমে নিজেদের অজ্ঞতাকে আবিষ্কারের চেষ্টা করে না। বরং তারা বেসামাল হয়ে গিয়েছে প্রাইভেট কোচিং আর পরীক্ষা নিয়ে। কেননা, যে করেই হোক পরীক্ষায় তার অবশ্য অবশ্যই ভালো ফলাফল চাই, তা না হলে যে শিক্ষাটাই অনর্থক, বলা যায় জীবনটাই বৃথা।

By admin

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *