জ্ঞান অর্জন করা প্রত্যেক মানুষের জন্য একটি অপরিহার্য কর্তব্য। কেননা, একজন সৎ ও জ্ঞানী মানুষ হলো যে কোন দেশের সব চেয়ে বড় সম্পদ। আর এই জ্ঞান অর্জিত হয় শিক্ষার মাধ্যমে। শিক্ষা মানুষকে সকল অবস্থায় সহনশীল হতে শেখায়। একমাত্র শিক্ষার মাধ্যমেই দেশ ও জাতিকে উন্নত করা যেতে পারে। অথচ আমাদের শিক্ষার্থীদের অবস্থা দেখে মনে হয় তাদের কাছে লেখাপড়ার মূল উদ্দেশ্যই হচ্ছে পরীক্ষা দিয়ে একটা ভালো ফলাফল অর্জন করা; জ্ঞান অর্জন করা এখানে একটা গৌণ ব্যাপার মাত্র। যে দেশের শিক্ষা ব্যবস্থায় শিক্ষার্থীদের কাছে শেখার থেকে পরীক্ষা সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ বলে বিবেচিত হয় সে শিক্ষা কখনোই কোন জাতিকে আত্মনির্ভরশীল হতে সহায়তা করতে পারেনা। প্রকৃতপক্ষে, সারা বছর জুড়ে পরীক্ষার জন্য স্ট্যাডি করা শিক্ষার্থীর কাজ নয়; বরং সারা বছর জুড়ে স্ট্যাডি করে শিক্ষার্থী কী শিখেছে তা মূল্যায়ন করার জন্যই পরীক্ষা গ্রহণ করা হয়। কিন্তু শিক্ষার্থীরা তো বটেই, সম্ভবত আমাদের মহান শিক্ষক ও অভিভাবকরাও এটা ভুলে গেছেন। ফলে যে শিক্ষক/শিক্ষা প্রতিষ্ঠান যত শর্টকার্টে শিক্ষার্থীকে একটা ভালো ফলাফলের নিশ্চয়তা দিতে পারেন তার কদর এখন সব থেকে বেশী। অথচ পরীক্ষা সম্পর্কে টমাস আলভা এডিসন বলেছিলেন, “আমি পরীক্ষা নিয়ে মোটেও চিন্তিত নই, কেননা পরীক্ষার কয়েকটা খাতার পৃষ্ঠা আমার ভবিষ্যত নির্ধারণ করতে পারে না।” আর বিল গেটস এর উক্তি হলো, “আমি পরীক্ষায় কিছু বিষয়ে ফেল করি, কিন্তু আমার কিছু সহপাঠী তা পাস করে যায়। আর এখন তারা মাইক্রোসফট এর ইঞ্জিনিয়ার এবং আমি তার মালিক।”

একজন শিক্ষাথী সারা বছর অধ্যায়ন করার পর যথানিয়মে পরীক্ষায় অংশ গ্রহণ করলে পরীক্ষার খাতায় ভুল/শুদ্ধ যাই লিখুক না কেন তার জন্য একটা নম্বর তার প্রাপ্য। কেননা, বছর জুড়ে নিয়মিত ক্লাশ করা ও পরীক্ষায় অংশ গ্রহণ করার ক্ষেত্রে তাকে অব্যশই কিছুটা ত্যাগ স্বীকার করতে হয়েছে। সুতরাং তার ত্যাগ এর বিনিময় কোনভাবেই শূন্য হতে পারে না। এখন তার এই ত্যাগ এর মাধ্যমে তিনি কতটা শিক্ষা অর্জন করতে সক্ষম হয়েছেন সেটা মূল্যায়ন করার জন্যই পরীক্ষার ব্যবস্থা। যেহেতু কোন শিক্ষার্থী যথাযথভাবে সারা বছর জুড়ে ক্লাশ করে যথানিয়মে পরীক্ষায় অংশ গ্রহণ করলে একটা ন্যূনতম নম্বর তিনি অবশ্যই পাবেন, পাশাপাশি শিক্ষণীয় বিষয়টি ভালোভাবে শিখে থাকলে পরীক্ষার খাতায় প্রশ্নের সঠিক জবাব লিথার জন্যও একটা নম্বর অবশ্যই তার প্রাপ্য, তাহলে বছর জুড়ে কেবলমাত্র পরীক্ষার জন্য স্ট্যাডি/অধ্যায়ন করার কী যৌক্তিকতা থাকতে পারে?

শিক্ষা সম্পর্কে নানা মনীষি নানা ধরণের উক্তি করেছেন। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এর ভাষায়, “তাকেই বলি শ্রেষ্ঠ শিক্ষা, যা কেবল তথ্য পরিবেশন করে না, যা বিশ্ব সত্তার সাথে সামঞ্জস্য রেখে আমাদের জীবনকে গড়ে তোলে।” সক্রেটিস বলেছিলেন, “যতদিন লেখাপড়ার প্রতি আকর্ষণ থাকে, ততদিন মানুষ জ্ঞানী থাকে, আর যখনই তার ধারণা জন্মে যে সে জ্ঞানী হয়ে গেছে, তখনই মূর্খতা তাকে ঘিরে ধরে।” ড. মুহাম্মদ ইউনূস এর মতে, “শিক্ষার উচিত তাকে উদ্যোক্তা বা চাকরি সৃষ্টিকারী হতে প্রস্তুত করা, চাকরি খুঁজতে নয়। আমরা যদি তরুণদের চাকরি সৃষ্টিকারী হিসেবে গড়ে তুলতাম, তাহলে বেকারত্ব বলে কিছু থাকত না।” এ.পি.জে. আব্দুল কালাম এর ভাষায়, “যে অন্যদের জানে সে শিক্ষিত, কিন্তু জ্ঞানী হলো সেই ব্যক্তি যে নিজেকে জানে| জ্ঞান ছাড়া শিক্ষা কোনো কাজেই আসেনা।”

বস্তুতঃ আমাদের ছেলে-মেয়েরা লেখাপড়া শিখে শিক্ষিত হচ্ছে বৈকি, কিন্তু জ্ঞানী হচ্ছে খুব কমই। শিক্ষাকে জাতির মেরুদন্ড বলা হলেও প্রকৃতপক্ষে আমাদের শিক্ষা এখন মেরুদন্ডহীন হয়ে পড়েছে। শিক্ষাকে সত্যিকার অর্থে জাতির মেরুদন্ড হিসেবে ফিরে পেতে তথা শিক্ষার মূল উদ্দেশ্য বাস্তবায়ন করতে হলে এদেশের শিক্ষা ব্যবস্থাকে ঢেলে সাজানো অত্যন্ত জরুরী। তা না হলে সনদপত্রধারী শিক্ষিত বেকার এর সংখ্যা দিন দিন যেভাবে বেড়ে চলেছে, খুব শিঘ্রই হয়তো তা ভয়াবহ আকার ধারণ করতে পারে। আশার কথা হচ্ছে, মাস্টার্স পাশ করেও এখন এদেশের ছেলে-মেয়েরা অফিস সহায়ক হিসেবে কাজ করতেও কুন্ঠাবোধ করেন না; আর দুরাশার কথা হচ্ছে ঐ অফিস সহায়কের পদটা বাগিয়ে নিতে তারা লক্ষ লক্ষ টাকা ঘুষ দিতেও দ্বিধাবোধ করেন না; কেননা, হাজার হোক সরকারী চাকরি বলে কথা। যে জাতির শিক্ষা ব্যবস্থা জাতিকে আত্মনির্ভরশীল হতে সহায়তা না করে ঘুষ দিয়ে চাকরি নিতে প্ররোচিত করে সে জাতি কখনোই স্বয়ংসম্পূর্ণ জাতি হিসেবে বিবেচিত হতে পারে না।

By admin

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *