প্রাণি মাত্রই ক্ষুধার অনুভূতি উপলব্ধি করে। মানুষ ভিন্ন পৃথিবীর অন্যান্য সকল প্রাণির মাঝে কমপক্ষে দু’ধরণের ক্ষুধার উপস্থিতি পরিলক্ষিত হয়, (১) জৈবিক ক্ষুধা (২) দৈহিক ক্ষুধা। মানুষের মাঝে তৃতীয় আর এক ধরণের ক্ষুধা রয়েছে যাকে বলা হয় আত্মিক ক্ষুধা। সম্ভবত এই আত্মিক ক্ষুধার কারণেই মানুষ সকল সৃষ্ট জীবের মধ্যে শ্রেষ্ঠ জীব হিসেবে বিবেচিত। তবে আত্মিক ক্ষুধা বিভিন্ন মানুষের মাঝে বিভিন্ন ভাবে ও বিভিন্ন মাত্রায় পরিলক্ষিত হয়। কারো কাছে টাকা-পয়সা, বাড়ী-গাড়ী, যশ-খ্যাতি অর্জন করাটা ক্ষুধা, আর কারো কাছে পরকালে ভালো থাকার জন্য ইহকালে ভালো কাজ করাটা ক্ষুধা। বস্তুত এগুলোর কোনটাই ক্ষুধার সংজ্ঞা দ্বারা ক্ষুধা হিসেবে বিবেচিত হয় না। কেননা, কোন প্রাণি একবার পেট ভরে খেলে পুনরায় সে খায় না যতক্ষণ পর্যন্ত না পেট আবার খালি হয়। কিন্তু টাকা-পয়সা, বাড়ী-গাড়ী, যশ-খ্যাতির বিষয়টা এরকম নয়, এগুলোকে ক্ষুধা হিসেবে না দেখে বরং নেশা হিসেবে দেখাই অধিকতর যুক্তিসঙ্গত।
আর পরকালে ভালো থাকার জন্য ইহকালে ভালো কাজ করা, এগুলো এখন কতকগুলো ধর্মীয় আচার-আচরণের মধ্যে সীমাবদ্ধ। পরকালে ভালো থাকতে হলে সত্যের পথে থাকতে হবে। কিন্তু কোন ধর্ম কি মানুষকে সত্যের পথে পরিচালিত করছে? প্রত্যেক ধর্মই কেবল নিজ নিজ ধর্মের আচার-আচরণগুলো শিক্ষা দেয় মাত্র, সত্য উদঘাটনে সহায়তা করে না। কোন এক বিশেষ ধর্মের কতিপয় আচার-আচরণ পরিপালনের মাধ্যমে কেবল ঐ ধর্মের সাথে একাত্মতা ঘোষণা করা হয়। সত্য অনুসন্ধান করতে হলে সকল ধর্মের প্রতি সমানভাবে সম্মান প্রদর্শন পূর্বক সকল ধর্মকে জানতে হবে। সুতরাং সত্য অনুসন্ধানের সুযোগ কিংবা চেষ্টা ব্যতিত কেবলমাত্র পরকালে ভালো থাকার জন্য ইহকালে ভালো কাজ করা তথা কতকগুলো আচার-আচরণ পরিপালন করাকে কখনোই ক্ষুধা হিসেবে বিবেচনা করা যায় না।
তাহলে মানুষের তৃতীয় ধরণের ক্ষুধা অর্থাৎ আত্মিক ক্ষুধা আসলে কোনটি? বস্তুতঃ অধিকাংশ মানুষের ক্ষেত্রেই এই ক্ষুধা এখন জৈবিক ক্ষুধার সাথে একিভূত হয়ে গেছে। আমাদের সময় আমরা পড়েছি/শুনেছি জ্ঞান অর্জন করা হচ্ছে এক ধরণের ক্ষুধা অথাৎ যারা জ্ঞান চর্চা করেন তারা মূলত তার মাধ্যমে তাদের আত্মিক ক্ষুধাই নিরসন করার চেষ্টা করেন। জ্ঞান পরিমাপে এখন আর অভিযোজন ক্ষমতা পরিমাপ করার দরকার হয় না। এখন যার পরীক্ষার ফলাফল যত ভালো তিনি তত জ্ঞানী। একটা বন্য পশু কিংবা সমুদ্রের একটা বৃহৎ প্রাণি নিজের খাবার নিয়ে যতটা না ভাবেন তার থেকেও অন্ততঃ হাজার গুণ বেশী ভাবেন বুদ্ধিদীপ্ত সম্পন্ন মানুষ। ফলে মানুষ যেটুকু জ্ঞান অর্জন করে তার সবটুকু নিয়োজিত করতে হয় কেবলমাত্র তার জৈবিক ক্ষুধা নিবারণের জন্য। জৈবিক ক্ষুধা নিবারণের জন্য মানুষ আজকাল যতটা যুদ্ধ করে সেই তুলনায় অন্যান্য পশুপাখি খাদ্য আহরণের জন্য যে চেষ্টা করে তা একেবারেই নগণ্য; অর্থাৎ মানুষের জায়গা তো এখন বলা চলে পশুর থেকেও নিচে?
সত্য অনুসন্ধান এবং জ্ঞান আহরণের জন্য প্রচুর স্ট্যাডি করতে হয়। কেবলমাত্র কতিপয় প্রশ্নের উত্তর লিখে দিয়ে জ্ঞানী হওয়া যায় না। ধর্মীয় জ্ঞান অর্জন কিংবা সত্য অনুসন্ধান করতে চাইলে সকল ধর্মের ধর্মীয় গ্রন্থগুলো স্ট্যাডি করা সকল ধর্মের অনুসারীদেরই উচিৎ। কিন্তু বাস্তবতা হলো এক ধর্মের অনুসারীগণ অন্য ধর্মের ধর্মীয় গ্রন্থ স্ট্যাডি করা তো দূরে থাক, স্ব স্ব ধর্মের ধর্মীয় গ্রন্থ ম্ট্যাডি করেন, এমন মানুষের সংখ্যাও খুবই নগণ্য। আর সাহিত্যের কথা তো বলাই বাহুল্য। বলা হয়ে থাকে, বন্যেরা বনে সুন্দর, শিশুরা মাতৃক্রোড়ে। আজকাল সাহিত্যের অবস্থাটাও ঠিক তেমনই, সাহিত্যের জ্ঞান সাহিত্যেই সুন্দর, জ্ঞানীদের কাজ অর্থ উপার্জন করা। তাই এখন জ্ঞান চর্চাকে কেউ আর ক্ষুধা হিসেবে গণ্যই করতে চাননা।